শিশুর বয়স ও দৈনিক শক্তি চাহিদা অনুসারে খাদ্য তালিকা

আজকের এই পোস্টের মাঝে আমরা আলোচনা করবো শিশুর বয়স ও দৈনিক শক্তি চাহিদা অনুসারে খাদ্য তালিকা সম্পর্কে। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে তাই পুরো বিষয় পড়ার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হইলো।

শিশুর-বয়স-ও-দৈনিক-শক্তি-চাহিদা-অনুসারে-খাদ্য-তালিকা

আমাদের শিশুর বয়স যখন ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় তখন আমরা তাদের মাঝে বিভিন্ন পরিবর্তন দেখতে পায় এবং এই পরিবর্তনগুলো মাঝে একটি সাধারণ পরিবর্তন আমরা দেখি খাদ্যের মাঝে।

পোস্টের মূল পয়েন্টসমূহ: শিশুর বয়স ও দৈনিক শক্তি চাহিদা অনুসারে খাদ্য তালিকা

শিশুর বয়স ও দৈনিক শক্তি চাহিদা অনুসারে খাদ্য তালিকা

আমরা সর্বপ্রথমেই জেনে আসি শিশুর বয়স ও দৈনিক শক্তি চাহিদা অনুসারে খাদ্য তালিকা সম্পর্কে। নিচে এটি নিয়ে একটি তালিকা দেওয়া হলো:

শিশুর বয়স

দৈনিক শক্তি চাহিদা

খাদ্য তালিকা

প্রথম দুই মাস

92 kcal/kg

অথার্ৎ প্রতি কেজি ওজনের জন্য ৯২ কিলোক্যালোরি শক্তি

দুই থেকে তিন ঘন্টা অন্তর কেবল মাত্র মাতৃদুগ্ধ খাওয়ানো।

তৃতীয় ও চতুর্থ মাস

দিনে তিন-চার ঘন্টা অন্তর মায়ের দুধ খাওয়ানো। রাত্রে এগারেটার পর চার-পাঁচ ঘন্টা বিরতি।

পঞ্চম ও ষষ্ঠ মাস

সাড়ে তিন থেকে সাড়ে চার ঘন্টা অন্তর মাতৃদুগ্ধ খাওয়ানো। রাত্রে এগারোটার পর পাঁচ-ছয় ঘন্টা বিরতি। ষষ্ঠ মাসে অন্নপ্রাশন বা আকিকা।

সপ্তম ও অষ্টম মাস

80 kcal/kg

অথার্ৎ প্রতি কেজি ওজনের জন্য ৮০ কিলোক্যালোরি শক্তি

মাতৃদুগ্ধের সঙ্গে গলা বাত, আলুসেদ্ধ, ডালসেদ্ধ, ফলের রস।

নবম ও দশম মাস

মাতৃদুগ্ধের সে্গ নরম ভাত, ডাল, সবজি, নরম ফুলকো রুটি, ডিমের কুসুম ও নরম মাছ, সঙ্গে ফলের রস। বিভিন্ন শাকসবজির সবুজ পাতা ও ডাল দিয়ে খিচুরী।

একাদশ ও দ্বাদশ মাস

মাতৃদুগ্ধের সঙ্গে ভাত, ডাল, সবজি, রুটি, ডিম, মাছ, নরম মুরগির মাংস, ছানা, দই, ফলের রস প্রভৃতি।

শিশুর মাতৃদুগ্ধের প্রকারভেদ সম্পর্কে জেনে নিন

আমরা উপরে জেনে আসলাম শিশুর বয়স ও দৈনিক শক্তি চাহিদা অনুসারে খাদ্য তালিকা সম্পর্কে। এবার আমরা জানবো শিশুর মাতৃদুগ্ধের প্রকারভেদ সম্পর্কে।

মাতৃদুগ্ধ প্রধানত দুই প্রকারের হয়, যথা- ১। কোলোস্ট্রাম এবং ২। পরিণত দুধ। নিচে দুই প্রকারের বর্ণনা ও উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে:

  • কোলোস্ট্রাম (Colostrum): সন্তান প্রসবের পর বেশ কয়েকদিন ধরে মায়ের ন্ততনগ্রন্থি থেকে এক শেষ প্রকারের হলুদ রঙের আঠালো রস অল্প পরিমাণে ক্ষরিত হতে থাকে। একে কোলোস্ট্রাম বলে। অথবা, শিশু জন্মের পর থেকে কেয়ক দিন পর্যন্ত (প্রায় তিন-চার দিন) মায়ের স্তনগ্রন্থি থেকে এক প্রকার হলুদ বর্ণের আঠালো তরল পদার্থ সামান্য পরিমাণে ক্ষরিত হতে থাকে, একে কোলোস্ট্রাম বলে।
  • কোলোস্ট্রামে উপস্থিত বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান: কোলোস্ট্রামে পরিণত মাতৃদুগ্ধের তুলনায় অল্প পরিমাণ স্নেহপদার্থ এবং অধিক পরিমাণে প্রোটিন থাকে। কোলোস্ট্রামের মধ্যে ট্রিপটেফ্যান নামে এক বিশেষ প্রকার অ্যামিনো অ্যাসিড খুব বেশি পরিমাণে থাকে। এটি শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য অপরিহার্য। কোলোস্ট্রামের মধ্যে প্রোটিন ছাড়াও অন্যান্য পরিপোষক উপাদান, খনিজ পদার্থ এবং কয়েক প্রকার ভিটামিন উপযুক্ত পরিমাণে থাকে। এই ভিটামিনগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল রেটিনল (ভিটামিন- A), ক্যালসিফেরল (ভিটামিন- D) এবং সায়ানোকোবালামিন (ভিটামিন- B12) কোলোস্ট্রামে ইনটারফেরন এবং অ্যান্টিবডির উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। কোলোস্ট্রামের এইসব উপাদান শিশুর দেজেহ রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে এবং উপযুক্ত মাত্রায় ক্যালোরি সরবরাহ করে। কোলোস্ট্রাম পুষ্টিগুণেও খুবই সমৃদ্ধ হয়। এতে দস্তার পরিমাণ ২০ mg/L, যেখানে স্বাভাবিক মায়ের দুধে দস্তার পরিমাণ ৫.৩ mg/L।
কোলোস্ট্রামের-উপকারিতা-সম্পর্কে-জেনে-নিন

কোলোস্ট্রামের উপকারিতা

নবজাতক কোলোস্ট্রাম পান করলে তার যকৃতে ভিটামিন অ সঞ্চিত হয়। কোলোস্ট্রামের মধ্যে উপস্থিত কয়েক প্রকার রোগপ্রতিরোধক পদার্থ শিশুকে হাম, বসন্ত, ইনফ্লুয়েঞ্জা, পোলিও প্রভৃতি রোগের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। এক কথায় কোলোস্ট্রাম শিশুর দেহে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে এবং শিশুকে দীর্ঘস্থায়ী সুস্থতা প্রদান করে।

কোলোস্ট্রামে উপস্থিত পরজীবী প্রতিরোধকারী (অনাক্রম্যতাজনিত) উপাদান:

  • ইমিউনোগ্লোবিউলিন (Immunoglobulin): মাতৃদুগ্ধে ইমিউনোগ্লোবিউলিন অ্যান্টিবডিরূপে কাজ করে। মাতৃদুগ্ধে অধিক পরিমাণে থাকে ইমিউনোগ্লোবিউলিন A বা IgA অ্যান্টিবডি, বাকি IgG ও IgM অল্প পরিমাণে থাকে। IgA, বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু, বিশেষ করে E. coli ব্যাকটেরিয়া, পোলিও ভাইরাস, স্ট্রেপটোকক্কাই, নিউমোকক্কাই ধ্বংস করে। প্রতি মিলি কোলোস্ট্রামে ২০-৪০ mg (20-40 mg/ml) এবং প্রতি মিলি পরিণত দুধে (mature milk) 1 mg (1 mg/ml) IgA থাকে।
  • লাইসোজাইম (Lysozyme): প্রতি মিলি মাতৃদুগ্ধে 2 mg (2mg/ml) লাইসোজাইম থাকে, যা ব্যাকটেরিয়ার প্রাচীর বিদীর্ণ করে ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে। ল্যাক্টোপারক্সিডেজ (Lactoperoxidase): স্ট্রেপটোকক্কাই জীবাণু ধ্বংসে সাহায্য করে।
  • ল্যাক্টোফেরিন (Lactoferrin): এটি একটি লৌহ যৌগঘটিত প্রোটিন, যা মাতৃদুগ্ধে প্রচুর পরিমাণে থাকে। এর কাজ হল E. Coli ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে দেওয়া।
  • শ্বেতকণিকা (Lymphoid cells): মাতৃদুগ্ধে বিভিন্ন ধরনের শ্বেতকণিকা বর্তমান। এদের মধ্যে লিম্ফোসাইট শ্বেতকণিকা ওমঅ উৎপন্ন করে। নিউট্রোফিল ও ম্যাক্রোফেজ, ফ্যাগোসাইটোসিস পদ্ধতিতে জীবাণু ধ্বংস করে।
  • ল্যাক্টোব্যাসিলাস বাইফিডাস ফ্যাক্টর (Lactobacillus bifid us factor): মাতৃদুগ্ধে নাইট্রোজেন ঘটিত পলিস্যাকারাইড বাইফিডাস ফ্যাক্টর নামক এক উপকারী জীবাণু বৃদ্ধি সহায়ক উপাদান থাকে, যা শিশুর অস্ত্রে ল্যাক্টোব্যাসিলাস বাইফিডাস ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি ঘটিয়ে উদরাময় সৃষ্টিকারী জীবাণুদের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে।
  • মনোগ্লিসারাইড ও ফ্যাটি অ্যাসিড (Monoglyceride and fatty acid): মাতৃদুগ্ধে উপস্থিত মনোগ্লিসারাইড ও ফ্যাটি অ্যাসিড শিশুর দেহে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধে সাহায্য করে।
  • পরিণত দুধ (Matured milk): কোলোস্ট্রাম ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে পরিণত দুধের রূপ পায় মায়ের পরিণত দুধই মাতৃদুগ্ধ নামে পরিচিত। পরিণত দুধে শিশুর পুষ্টির জন্য অপরিহার্য পরিপোষক উপাদান, হরমোন উৎসেচক, গ্লোবিউলিন ইত্যাদি উপস্থিত থাকে।
  • পরিণত দুধে উপস্থিত বিভিন্ন পরিপোষক উপাদান: পরিণত দুধে ৪৪% জল ও বাকি ১২% বিভিন্ন প্রকার পৌষ্টিক উপাদান থাকে। প্রতি 100 ml পরিণত দুধে অর্থাৎ মায়ের দুধে ৭ম শর্করা, 7g শর্করা, 1.1g প্রোটিন এবং 3.5g স্নেহপদার্থ থাকে| তাছাড়া, প্রতি 100 ml মাতৃদুগ্ধের পুষ্টিমূল্য 67 থেকে 71kcal| প্রতি 100ml মাতৃদুগ্ধের 0.3 ল্যাকট্যালবুমিন থাকে। ল্যাকট্যালবুমিনের আমিনো অ্যাসিড সজ্জা দেহজ প্রোটিনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়ায় সেটি সহজে পাচিত ও শোষিত হতে পারে। অন্যদিকে, গোরুর দুধে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি (শতকরাv 3.3g) হওয়ায় Z সহজে হজম হয় না। তাছাড়া, গোরুর দুধে ৮০% কেসিন থাকায় তা অর্ধকঠিন দই-জাতীয় পদার্থে পরিবর্তিত হয় এবং সহজে পাচিত ও শোষিত হতে পারে না । মাতৃদুগ্ধে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন সুষমভাবে থাকে। প্রতি 100 ml পরিণত দুধে 137 μg ক্যারোটিন, 0.02 mg থায়ামিন, 0.02 mg রাইবোফ্লেভিন এবং 1.2-11 mg অ্যাসকরবিক অ্যাসিড থাকে। তবে সেগুলির পরিমাণ নির্ভর করে মায়ের উপযুক্ত পরিমাণ খাদ্যগ্রহণের ওপর। মাতৃদুগ্ধকে গরম করার প্রয়োজন হয় না, তাই ভিটামিন B কমপ্লেক্স এবং ভিটামিন C-এর পুষ্টিগুণ উপযুক্তমাত্রায় বজায় থাকে। মাতৃদুগ্ধ ফোলিক অ্যাসিডের শোষণও বৃদ্ধি করে। গোরুর দুধের তুলনায় মায়ের দুধে ভিটামিন A, C এবং E অধিক পরিমাণে থাকে।

  • মাতৃদুগ্ধের অপর একটি পুষ্টিগত গুরুত্ব হল, এতে ক্যালশিয়াম এবং ফসফরাস উপযুক্ত পরিমাণে থাকে। প্রতি 100 ml মাতৃদুগ্ধে 33 mg ক্যালশিয়াম এবং 15 mg ফসফরাস থাকে। মাতৃদুগ্ধে উপস্থিত লৌহ খুব ভালোভাবে শিশুর দেহে শোষিত হয়। এতে তামার পরিমাণও বেশি থাকে। মাতৃদুগ্ধে থাকা ল্যাকটোজ শিশুর দেহে জিংক ও ক্যালশিয়ামের শোষণ বৃদ্ধি করে।

মাতৃদুগ্ধের বা মায়ের পরিণত দুধের উপকারিতা 

আমরা শিশুর বয়স ও দৈনিক শক্তি চাহিদা অনুসারে খাদ্য তালিকা সম্পর্কে উপরে জেনে এসেছি, এখন আমরা জানবো মাতৃদুগ্ধের বা মায়ের পরিণত দুধের উপকারিতা সম্পর্কে। শিশুকে মায়ের দুধ পান করানোর উপকারিতা বা পুষ্টিগত সুবিধাগুলি হল:

  • মায়ের দুধে শর্করা, প্রোটিন এবং স্নেহপদার্থ যথেষ্ট পরিমাণে থাকে। তা ছাড়া, প্রতি 10 ml মায়ের দুধের শক্তির পরিমাণ 67 থেকে 71 kcal| মায়ের দুধে ল্যাকট্যালবুমিন থাকায় তা গোরুর দুধের তুলনায় সহজে পাচিত ও শোষিত হতে পারে। অন্যদিকে গোরুর দুধে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি (3.3gm) হওয়ায় তা সহজে হজম হয় না। 
  • মায়ের দুধ সহজে শিশুকে দেওয়া যায়। শিশুরা চাহিদামতো মায়ের দুধ পান করে থাকে। গোদুগ্ধ বা অন্যান্য দুগ্ধের তুলনায় এটি অনেক বেশি স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ। কারণ, এই দুধ মায়ের দেহ থেকে সরাসরি সন্তানের পৌষ্টিকতন্ত্রে গৃহীত হয়। 
  • স্বাভাবিক অবস্থায় মাঝারি স্বাস্থ্যের স্তন্যদাত্রী মা প্রতিদিন 400 থেকে 600 ml শিশুকে দিতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষরণের পরিমাণ কমবেশি হয়। 
  • মায়ের দুধ শিশুকে শৈশবকালীন মেদবহুলতা থেকে রক্ষা করে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, শিশুকে গোরুর দুধ পান করালে তাতে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি থাকায় শিশু শৈশবেই মোটা হতে শুরু করে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেহে মেদ বৃদ্ধির কারণে মধুমেহ দেখা দেয় । 
  • মায়ের দুধ শিশুর দেহে ক্যালশিয়াম এবং ফসফরাসের সঠিক মাত্রা বজায় রাখতে সহায়তা করে। মায়ের দুধের পরিবর্তে গোরুর দুধ নিয়মিত পান করালে শিশুর দেহে এই দুটি উপাদান অনেক বেড়ে যায় ।

জেনে রাখো:

  • শিশুর ওজন প্রতি সপ্তাহে গড়ে 120g বৃদ্ধি পায়।
  • রাত্রি ১১ টা থেকে ভোর ৫ টা পর্যন্ত দুধ পান করানোর প্রয়োজন হয় না।
  • শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মা ও শিশুকে প্রায় ৬ ঘণ্টা বিশ্রাম দেওয়া উচিত।
  • শিশুর দৈনিক 600ml দুধের প্রয়োজন।

মাতৃদুগ্ধের পুষ্টিগত মূল্য (Nutritive value of breast milk)

পশুর দুধ অপেক্ষা মাতৃদুগ্ধে জলের ভাগ বেশি হওয়ায় তা শিশুর পক্ষে হজম করা সহজ হয়। খাদ্যের ৬টি উপাদানই মাতৃদুগ্ধে বর্তমান, যা শিশুর দেহের পক্ষে উপযুক্ত।
শর্করা, প্রোটিন ও স্নেহপদার্থ: পশুর দুধ অপেক্ষা মাতৃদুগ্ধে জলের ভাগ বেশি হওয়ায় তা শিশুর পক্ষে হজম করা সহজ হয়। খাদ্যের ৬টি উপাদানই মাতৃদুগ্ধে বর্তমান, যা শিশুর দেহের পক্ষে উপযুক্ত।

শর্করা, প্রোটিন, স্নেহপদার্থ, ভিটামিন, খনিজ পদার্থ ও জল: 

  • শর্করা: মাতৃদুগ্ধে উপস্থিত ল্যাকটোজজাতীয় শর্করা ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালশিয়াম ও অ্যামিনো অ্যাসিড শোষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ল্যাকটোজ পাচিত হয়ে গ্যালাকটোজ উৎপন্ন করে যা স্নায়ু কোশের মায়েলিন পর্দা গঠনে সহায়তা করে। মায়ের দুধে অ্যামাইলেজ নামক শর্করা পরিপাককারী উৎসেচক বর্তমান।
  • প্রোটিন: মাতৃদুগ্ধে ল্যাকট্যালবুমিন নামক প্রোটিন থাকে। এই প্রোটিন সহজে পাচিত হয়ে শিশুর দেহে শোষিত হয়। ল্যাকট্যালবুমিনে উপস্থিত অ্যামিনো অ্যাসিড শিশুর দেহগঠনে অংশ নেয় এবং শিশুর দেহে অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিডের চাহিদা পূরণ করে। মাতৃদুগ্ধে সিসটিন, মিথিওনিন এবং টরিন নামক অ্যামিনো অ্যাসিড যথেষ্ট পরিমাণে থাকে। টরিন একটি সালফারযুক্ত অ্যামিনো অ্যাসিড। এটি শিশুর কেন্দ্রীয় নার্ভতন্ত্র গঠনে সাহায্য করে। মাতৃদুগ্ধে প্রোটিন ভঙ্গক এনজাইমও থাকে। ওই এনজাইম প্রোটিনকে বিশ্লেষণ করে পেপটোনে পরিবর্তিত করতে পারে। গোরুর দুধে উপস্থিত প্রোটিন ভঙ্গকারী উৎসেচক দুধ গরম করা (pasteurisation)- এর সময় নষ্ট হয়ে যায়। 
  • স্নেহপদার্থ: মাতৃদুগ্ধে প্রচুর পরিমাণে স্নেহপদার্থ বা ফ্যাট থাকে। এই ফ্যাটই শিশুর শক্তিচাহিদার প্রায় ৫০ শতাংশ সরবরাহ করে। মাতৃদুগ্ধের ফ্যাটে কোলেস্টেরলসহ অন্যান্য অপরিহার্য ফ্যাটি অ্যাসিড বর্তমান। মায়ের দুধে উপস্থিত ফ্যাটের।

  • ভিটামিন: মাতৃদুগ্ধে যথেষ্ট পরিমাণে ভিটামিন A, C, E এবং ভিটামিন B কমপ্লেক্স থাকে। শিশু সরাসরি মায়ের দেহ থেকে দুধ পান করে বলে, এই দুধকে আলাদাভাবে গরম করার প্রয়োজন হয় না। ফলে অধিক উত্তাপে ভিটামিন B কমপ্লেক্স এবং ভিটামিন C-এর অপচয় হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে না । মায়ের দুধের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এটি শিশুর দেহে ফোলিক অ্যাসিডের শোষণ বৃদ্ধি করে।
  • খনিজ পদার্থ: মাতৃদুগ্ধে যথেষ্ট পরিমাণে ক্যালশিয়াম এবং ফসফেট থাকে। প্রতি 100 ml দুধে ক্যালশিয়াম ও ফসফরাসের পরিমাণ যথাক্রমে 33 mg ও 15 mg| এছাড়া মাতৃদুগ্ধে খুব অল্প পরিমাণ লোহা ও তামা থাকে। এই দুটি খনিজ পদার্থ শিশুর দেহে ভালোভাবে শোষিত হতে পারে। মাতৃদুগ্ধের আর-একটি বৈশিষ্ট্য হল-এটি জিংক-এর শোষণ বৃদ্ধি করে।
  • জল: মায়ের দুধে ৪৪% জল থাকায়, তা শিশুর পৌষ্টিকতন্ত্রের পক্ষে সহজপাচ্য। এ ছাড়াও জলের পরিমাণ বেশি হওয়ায় গরমকালে শিশুকে জল না খাওয়ালেও চলে। ফলে, জলবাহিত বিভিন্ন রোগের হাত থেকে রক্ষা পায়।

মাতৃদুগ্ধের-সুফল

মাতৃদুগ্ধের সুফল সম্পর্কে জেনে নিন

মাতৃদুগ্ধ মা ও শিশু উভয়কেই দৈহিক, মানসিক ও আর্থিক সুফল দান করে, যেমন:
অনাক্রম্যতাজনিত সুফল:

  • মাতৃদুগ্ধে উপস্থিত রোগপ্রতিরোধকারী উপাদানগুলি হল- লাইসোজাইম, ল্যাকটোফেরিন, ম্যাক্রোফাজ, লিম্ফোসাইট, ইমিউনোগ্লোবিউলিন A এবং অল্প পরিমাণ ইমিউনোগ্লোবিউলিন M| এগুলি শিশুর দেহে অনাক্রম্যতা গড়ে তোলে।
  • লাইসোজাইম উৎসেচক দুধে উপস্থিত পারক্সাইড ও ভিটামিন দ্বারা নিষ্ক্রিয় ব্যাকটেরিয়ার কোশপ্রাচীরকে আক্রমণ করে। দুধে উপস্থিত ল্যাকটোপারক্সিডেজ স্ট্রেপটোকক্কাস নামক ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে।
  • ল্যাকটোফেরিন উপাদানটি পেটের অসুখ প্রতিরোধে সাহায্য করে। এটি অন্ত্রে ই. কোলাই, স্ট্রেপটোকক্কাস প্রভৃতি ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি প্রতিহত করে।
  • উদ্ভিদ খাদ্যে অত্যাবশ্যকীয় এমাইনো এসিডের ঘাটতি থাকে। গল ও গমে অপর্যাপ্ত লাইমিন থাকে, তবে মেথিওনিন পর্যাপ্ত থাকে। ভালে লাইমন পর্যাপ্ত থাকে তবে মেথিওনিন কম থাকে। তাই চাল-ডালের মিশ্রণে উভয় খাদ্যেল অপর্যাপ্ত এ্যামাইনো এসিড পূরণ করে প্রোটিনের পুষ্টি মান উন্নত হয়। উদ্ভিদ খাদ্যের সাথে কিছু প্রাণিজ খাদ্য মেশালেও প্রোটিনের পরিমাণ বাড়ে। যেমন- দুধ-রুটি, দুধ-ভাত, দুধ-মুজি ইত্যাদি।

প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য দৈনিক প্রতিকিলো গ্রাম B... Weight এর জন্য ০.৮ বা ১ গ্রাম প্রোটিন দরকার।
এ হিসেবে-
৫৫ কেজি ওজনের একজন পুরুষের জন্য দৈনিক প্রোটিনের চাহিদা: ৫৫*০.৮= ৪৪ গ্রাম
৪৫ কেজি ওজনের একজন মহিলার দৈনিক প্রোটিনের চাহিদা-
৪৫*০.৮গ্রাম
= ৩৬.০ গ্রাম

বয়স ভিত্তিক প্রোটিনের তালিকা

শিশুদের দৈনিক বৃদ্ধির হার বেশী বলে শিশুদের জন্য প্রথম ৬ মাসে প্রতি কেজি ওজনে ২৫-২.২ গ্রাম প্রোটিন লাগবে।

বয়স

দেহের ওজন (KG)

শক্তির পরিমাণ
(KED)

প্রোটিনের পরিমাণ

(২-৬) মাস

(3.3-7.8) kg

118 ked

2.0g

(৬-১২) মাস

(4-10) kg

108 ked

1.7g

(১-৩) বছর

12.9 kg

1220 ked

16.7g

(৪-৬) বছর

18 kg

1820 ked

20.1g

(৭-৯) বছর

25 kg

1690 ked

29.5g

বালক: ১০-১২
বালীকা: ১০-১২
34.3 kg
35 kg
2190 ked
2010 ked
54.3g
51.9g
বালক: ১৩-১৫
বালীকা: ১৩-১৫
47.6 kg
46.6 kg
2750 ked
2330 ked
54.3g
51.9g

বালক: ১৬-১৭
বালীকা: ১৬-১৭

55.4 kg
52.1 kg

3020 ked
2440 ked

61.5g
55.5

কিশোর: ১৬-১৭
কিশোরী: ১৬-১৭

55.4 kg
55 kg

 

61.5g
55.5g

পুরুষ:
নারী:

60 kg
55 kg

 

60g
55g

শেষ কথন

শেষ কথন হিসেবে বলা যায়- শিশুর সুস্থ বিকাশ ও সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করতে তার বয়স অনুযায়ী সঠিক খাদ্য তালিকা নির্ধারণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি বয়সের শিশুর শরীরের চাহিদা ভিন্ন হয়, তাই খাবারের পরিমাণ ও পুষ্টির মানও বয়স অনুযায়ী সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত। সুষম খাদ্য গ্রহণ শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

শিশুর দৈনিক শক্তি চাহিদা পূরণের জন্য সঠিক মাত্রায় প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, ভিটামিন ও মিনারেল থাকা জরুরি। শিশুর বয়স অনুযায়ী ক্যালরি চাহিদা নির্ধারণ করে তাকে খাবার খাওয়ানো উচিত। জন্মের পর প্রথম ছয় মাস মায়ের দুধই শিশুর একমাত্র খাদ্য হওয়া উচিত। ছয় মাস পর ধাপে ধাপে বাড়তি খাবার যুক্ত করা যায়, যেমন চালের ভাত, ডাল, শাকসবজি ও ফলমূল। এক বছর বয়স থেকে শিশু ধীরে ধীরে পরিবারের অন্যান্য খাবারের সাথে অভ্যস্ত হতে পারে, তবে নরম ও সহজপাচ্য খাবার দেওয়া উচিত।

সঠিক খাদ্য তালিকা মেনে চললে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সঠিকভাবে ঘটে এবং সে সুস্থ ও সক্রিয় জীবনযাপন করতে পারে। অতিরিক্ত চিনি ও প্রসেসড খাবার থেকে দূরে রাখা উচিত, কারণ এগুলো শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

অভিভাবকদের উচিত শিশুর পুষ্টি চাহিদা সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী খাবারের পরিকল্পনা করা। স্বাস্থ্যকর খাবার ও পর্যাপ্ত পানি পান নিশ্চিত করলেই শিশুর শরীর সুস্থ থাকবে এবং সে ভবিষ্যতে একজন কর্মক্ষম ও মেধাবী মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে।

আমরা আশা করছি আপনি আমাদের পোস্টটি সম্পূর্ণ পড়েছেন এবং শিশুর বয়স ও দৈনিক শক্তি চাহিদা অনুসারে খাদ্য তালিকা সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। 

আমাদের মূল লক্ষ্য হলো আপনাদের মাঝে সঠিক তথ্যগুলোকে উপস্থাপন করা এবং পৌঁছে দেওয়া এবং এতে আপনাদের সহযোগীতা আমরা একান্তভাবে কাম্য করছি। লেখাটি আপনাদের পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও আরো অন্যান্যদের নিকট শেয়ার করে তাদেরও এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি জানার সুযোগ করে দিন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন