ফরজ গোসল যা একজন মুসলমানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এটি সম্পর্কে
জানা এবং ফরজ গোসলের সঠিক তরিকা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি মুসলামনের
জন্য অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আপনি যদি একজন মুসলিম হয়ে থাকেন তবে
আপনার উচিত ফরজ গোসল কিভাবে করতে হয় এবং ফরজ গোসলের নিয়ম ও দোয়া সম্পর্কে
সঠিক তথ্য গ্রহণ করা।
আজকে আমাদের আলোচনার মূল বিষয়টি হচ্ছে ফরজ গোসল কিভাবে করতে হয় এবং ফরজ
গোসলের নিয়ম ও দোয়া। আমরা আজকে এই লেখার মাঝে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো এবং
জানবো ফরজ গোসল কিভাবে করতে হয় এবং আরও এই বিষয়ে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
সম্পর্কে। চলুন তবে জেনে নেওয়া যাক।
পোস্টের মূল পয়েন্টসমূহ: ফরজ গোসল কিভাবে করতে হয় - ফরজ গোসলের নিয়ম ও
দোয়া
ফরজ গোসল কখন করতে হয়
ফরজ গোসল ইসলামের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান, যা শারীরিক ও আত্মিক
পরিশুদ্ধি অর্জনের জন্য আবশ্যক। ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ী, নির্দিষ্ট কিছু
পরিস্থিতিতে ফরজ গোসল করতে হয়, যা মুসলিমদের ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে পালন করতে
হয়।
ফরজ গোসলের প্রয়োজন হয় মূলত তিনটি অবস্থায়:
-
স্বপ্নদোষ বা সহবাসের ফলে বীর্যপাত হলে,
-
নারীদের ঋতুস্রাব বা মাসিক শেষ হওয়ার পর এবং
এই অবস্থাগুলোতে পবিত্রতা পুনরুদ্ধার করতে ফরজ গোসল জরুরী। এর মাধ্যমে
মুসলিমরা নিজেদের দেহ এবং মনকে পবিত্র করেন, যা তাদের ইবাদতে আত্মপ্রকাশ করতে
সহায়তা করে। ফরজ গোসলের উদ্দেশ্য শুধু দেহের ময়লা পরিষ্কার করা নয়; বরং এটি
একটি ধর্মীয় বিধান যার মাধ্যমে আত্মিক পরিচ্ছন্নতা লাভ হয়। ইসলামের
নির্দেশিকা অনুযায়ী, ফরজ গোসলের জন্য নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম পালন করতে হয়। এই
নিয়মগুলো ঠিকভাবে পালন করলে ফরজ গোসল পূর্ণ হয় এবং নামাজসহ অন্যান্য ইবাদতের
জন্য ব্যক্তিকে পবিত্র মনে করা হয়। পবিত্রতা ইসলামের একটি বড় শিক্ষা, এবং ফরজ
গোসল এই পবিত্রতার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনে শৃঙ্খলা,
স্বাস্থ্য এবং আত্মিক পরিচ্ছন্নতা আনয়ন করে।
গোসলের ফরজ কয়টি ও কি কি
গোসলের পূর্বে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ বিধান রয়েছে, যেগুলো পালন না করলে
আপনার গোসল সঠিকভাবে হবেনা। তবে চলুন ফরজ গোসল কিভাবে করতে হয় - ফরজ গোসলের
নিয়ম ও দোয়া জানা আগে আমরা জেনে নেই গোসলের ফরজ কয়টি ও কি কি?
০১. ভালোভাবে কুলি করা। (সুরা মায়িদা: ০৬)
গড়গড়াসহ কুলি করা সুন্নাত। তবে রোজাদার হলে গড়গড়াসহ কুলি করা যাবে না, শুধু
কুলি করবে।
০২. নাঁকের নরম স্থান পর্যন্ত পানি পৌঁছানো।
(সুরা মায়িদা: ০৬)
নাকের মধ্যে শুকনো ময়লা থাকলে তাও পরিষ্কার করবে। তবে রোজা অবস্থায় শুধু নাকে
পানি দিবে, নরম হাড় পর্যন্ত পানি পৌঁছানো যাবে না।
০৩. সমস্ত শরীরে পানি পৌঁছানো ফরজ, যেন কোথাও এক চুল পরিমাণ শুকনো না থাকে।
(সুরা মায়িদা: ০৬, তিরমিজি: ১০৩, আল বাহরুর রায়িক: ১/৪৫, ফাতাওয়ায়ে শামি:
১/১৫১, হিদায়া: ১/২৯)
ফরজ গোসলের দোয়া
বাংলা উচ্চারণ: “নাওয়াইতুল গুছলা লিরাফইল জানাবাতি।”
অর্থ: “আমি নাপাকি থেকে পাক হওয়ার জন্য গোসল করছি।”
ফরজ গোসল কিভাবে করতে হয় - ফরজ গোসলের নিয়ম
আমরা উপরে বলে এসেছি যে, ফরজ গোসলের কিছু তরিকা বা নিয়ম রয়েছে। যদি এই নিয়ম
অনুযায়ী গোসল না করা হবে সেটিকে ফরজ গোসল হিসেবে গণ্য করা হবেনা। চলুন তবে এবার
জেনে আসা যাক ফরজ গোসল কিভাবে করতে হয় এবং ফরজ গোসলের নিয়ম
সম্পর্কে।
০১. গোসলের আগে ইসতিনজা সেরে নেবে। এতে বীর্য ইত্যাদি সম্পূর্ণরূপে বের হওয়া
সহজ হয়।
০২. শুরুতে নিয়ত করবে এবং 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' পড়বে।
(হাদিস-বুখারি: ২৪৮)
[বি.দ্র. গোসলখানা ও টয়লেট একত্রে হলে 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' মুখে
পড়া যাবে না।]
০৩. দুই হাত কবজি পর্যন্ত পৃথকভাবে তিনবার ধুয়ে নেবে।
(হাদিস-বুখারি: ২৪৮)
০৪. এরপর ডান হাতে পানি নিয়ে বাঁ হাত দিয়ে শরীরের যেসব জায়গায় বীর্য ও নাপাকি
লেগে থাকে, তা তিনবার ধুয়ে পরিষ্কার করবে।
(হাদিস-মুসলিম: ৩২১)
০৫. নাপাকি লেগে থাকুক বা না থাকুক সর্বাবস্থায় লজ্জাস্থান ধুয়ে নেবে এবং এরপর
উভয় হাত ভালো করে ধুয়ে ফেলবে। (হাদিস-বুখারি: ২৪৯)
০৬. তারপর নামাজের অজুর মত ভালোভাবে অজু করবে, তবে পা ধুয়ে ফেলবেন না। গোসলের
শেষে ধুয়ে নেবে। (হাদিস-বুখারি: ২৫৭-২৫৯)
০৭. অতঃপর পুরো শরীর ধোয়ার জন্য প্রথমে মাথায় পানি ঢালবে।
(হাদিস-বুখারি: ২৫৬)
০৮. তিনবার ডান কাঁধে তারপর তিনবার বাম কাঁধে পানি ঢালবে।
(হাদিস-বুখারি: ২৫৪)
০৯. পুরো শরীর ভালোভাবে ধুতে হবে, যেন শরীরের কোনো অংশ এমনকি কোনো পশমও যেন
শুকনো না থাকে। (হাদিস-বুখারি: ২৭৪, আবু দাউদ: ৪৯, ইবনু আবি শাইবা:
৮১৩)
তবে সাগর, নদী, পুকুর ইত্যাদিতে গোসল করলে কিছুক্ষণ ডুব দিয়ে থাকলে তিন বার
পানি ঢালার সুন্নাত আদায় হয়ে যাবে।
(হাদিস-আবু দাউদ: ২৪৯, ইবনু আবি শাইবা: ৮১৩)
১০. সমস্ত শরীর হাত দ্বারা ঘষে মেজে ধুয়ে নেবে।
(হাদিস-তিরমিজি: ১০৬)
১১. নাভি, বগল ও অন্যান্য জায়গায় পানি দিয়ে ভালোভাবে ধুতে হবে। সব শেষে গোসলের
জায়গা থেকে সামান্য সরে গিয়ে দুই পা তিনবার ধুয়ে নেবে।
(হাদিস-হিদায়া: ১/৩০)
১২. উঁচু স্থানে বসে গোসল করবে, যাতে পানি গড়িয়ে যায় ও গায়ে নাপাকির ছিটা না
লাগে। পানির অপচয় না করে, বসে বসে গোসল করবে। লোকসমাগমের স্থানে গোসল করবে না।
নাপাকি থেকে পবিত্র এমন জায়গায় গোসল করবে। ডান দিক থেকে গোসল শুরু করবে।
(হাদিস-বাদায়েউস সানায়ে: ১/৩৪, রদ্দুল মুহতার: ১/৯৪)
১৩. বাহ্যিক অঙ্গের চুল পরিমাণ জায়গাও শুকনো থাকলে ফরজ গোসল শুদ্ধ হবে না।
(হাদিস-আবু দাউদ: ২৫৯, শারহু মুখতাসারুত তহাবি: ১/৫১০)
১৪. নেইলপলিশ (Nail polish), রং বা সুপার গ্লু ইত্যাদি যা শরীরের ত্বকে পানি
পৌঁছার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়, তা উঠিয়ে নিচে (অর্থাৎ, ত্বকে) পানি পৌঁছানো
জরুরী, অন্যথায় গোসল শুদ্ধ হবে না।
(হাদিস-ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ১/১৩)
১৫. ফরজ গোসলে পুরুষের দাড়ি ও মাথার চুল গোড়াসহ সম্পূর্ণ ভালোভাবে ভিজতে
হবে।
নারীদের চুল বাঁধা থাকলে, তা খোলা ছাড়াই যদি চুলের গোড়ায় পানি পৌঁছানো সম্ভব
হয়, তাহলে না খুলে শুধু চুলের গোড়ায় পানি পৌঁছানোই যথেষ্ট। আর যদি চুল খোলা
থাকে তাহলে পুরুষের মতো চুলের গোড়াসহ সম্পূর্ণ চুল ধোয়া ফরজ।
(হাদিস-বাদায়েউস সানায়ে: ১/৩৪, রদ্দুল মুহতার: ১/১৪২)
১৬. ফরজ গোসলে নারীদের কান ও নাকফুল নাড়িয়ে ছিদ্রে পানি পৌঁছানো জরুরী।
(হাদিস-আল মুহিতুল বুরহানি: ১/৮০)
* কানের ভেতর ও নাভিতে পানি পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা
জরুরি।
১৭. গোসলের ভেজা কাপড় বালতি বা এ-ধরনের ছোট পাত্রে ধোয়া হলে কমপক্ষে তিনবার
ধুয়ে তিনবার নিংড়াবে, যেন নাপাকির চিহ্নমাত্র না থাকে।
তবে নাপাকি লেগে থাকা কাপড় যদি প্রবহমান পানি যেমন, নদী, পুকুরে বা ট্যাপের
পানিতে এতো বেশি করে ধোয়া হয়, যাতে নাপাকি দূর হওয়ার ব্যাপারে প্রবল ধারণা
হয়ে যায়- তাহলে তা পাক-পবিত্র হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে তিনবার নিংড়িয়ে ধোয়া
জরুরি নয়। (হাদিস সমূহ: রদ্দুল মুহতার: ১/৩৩৩, আল বাহরুর রায়িক: ১/২৩৭, ফাতাওয়ায়ে
হাক্কানিয়া: ২/৫৭৪, জামিউল ফাতাওয়া: ৫/১৬৭)
এটাই হচ্ছে গোসলের পরিপূর্ণ সঠিক পদ্ধতি।
ফরজ গোসলের পর কি ওযু করতে হবে
অনেকই মনে করেন গোসল শেষে নামাজ পড়তে চাইলে আবার নতুন করে অজু করতে হবে- যা
সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। উপরে বর্ণিত পদ্ধতিতে গোসল করলে গোসল শেষে নামাজ পড়তে
চাইলে আবার নতুন করে অজু করা লাগবে না। তবে গোসলের মাঝেই যদি অজু ভাঙার কোন
কারণ পাওয়া যায় তাহলে গোসল শেষে আবার অজু করতে হবে।]
শেষ কথন
আমরা মুসলিম হিসেবে আমাদের ফরজ গোসলের সঠিক নিয়মাবলী সম্পর্কে জানা খুবই
গুরু্ত্বপূর্ণ একটি বিষয় এবং আমরা আজকে পরিপূর্ণ ভাবে জানতে পারলাম যে, ফরজ
গোসল কিভাবে করতে হয় - ফরজ গোসলের নিয়ম ও দোয়া। আমাদের দায়িত্ব মুসলিম
হিসেবে আমাদের এই ফরজ বিধানটি মেনে চলা। ফরজ গোসল যা সম্পর্কে পবিত্র আল-কুরআন
ও হাদিসে স্পষ্টভাবে বলা রয়েছে। তাই এটি এড়িয়ে চললে আমাদের হবে না। আমরা ফরজ
গোসলের প্রতিটি নিয়ম সঠিকভাবে পালন করে দেহ, মন, মস্তিষ্ককে এর মাধ্যমে
পরিপূর্ণ রূপে পরিষ্কার করবো। “মহান আল্লাহ্ তায়ালা আমাদের সহায় হোক”।
‘আমিন’।
আমরা আশা করছি আপনি আমাদের পোস্টটি সম্পূর্ণ পড়েছেন এবং ফরজ গোসল কিভাবে করতে
হয় - ফরজ গোসলের নিয়ম ও দোয়া সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও জ্ঞান অর্জন
করতে সক্ষম হয়েছেন।
আমাদের মূল লক্ষ্য হলো আপনাদের মাঝে সঠিক তথ্যগুলোকে উপস্থাপন করা এবং পৌঁছে
দেওয়া এবং এতে আপনাদের সহযোগীতা আমরা একান্তভাবে কাম্য করছি। লেখাটি আপনাদের
পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও আরো অন্যান্যদের নিকট শেয়ার করে তাদেরও এই গুরুত্বপূর্ণ
বিষয়টি জানার সুযোগ করে দিন।